আল্লাহর শেষ রসুল (সা.) পৃথিবীতে কী পরিবর্তন ঘটাতে এসেছিলেন? তিনি কি এমন একটি জাতি সৃষ্টি করতে এসেছিলেন যাদের সবাই আরবের পোশাক পরিধান করবে, দাড়ি রাখবে? যার সদস্যরা সবাই হবে আরবি ভাষার পণ্ডিত?
নাকি তিনি এসেছিলেন সমাজ থেকে সকল জাহেলিয়াত, সকল অন্যায়, অবিচার, অশান্তি, জুলুম, রক্তপাত, অশ্রু দূর করে একটি শান্তি, ন্যায়, সুবিচারপূর্ণ সমাজ বিনির্মাণের জন্য?
বস্তুত তিনি এমন একটি জাতি তৈরি করার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করেছিলেন যে জাতির সদস্যরা অক্লান্ত পরিশ্রম করে, জীবন ও সম্পদ দিয়ে লড়াই করে সমগ্র পৃথিবীকে আল্লাহর নাজিল করা ভারসাম্যপূর্ণ জীবনব্যবস্থার অধীনে নিয়ে আসবে। পবিত্র কোর’আনের অতন্ত তিনটি আয়াতে আল্লাহ এই উদ্দেশ্যকে নিশ্চিত করেছেন। তিনি বলেছেন,
“তিনি আল্লাহ যিনি তাঁর রসুলকে প্রেরণ করেছেন সঠিক পথনির্দেশ (হেদায়াহ) ও সত্যদীন সহকারে যেন তিনি সকল প্রচলিত জীবনব্যবস্থার উপরে একে বিজয়ীরূপে প্রতিষ্ঠা করেন।” (সুরা তওবা ৩৩, সুরা সফ ৯, সুরা ফাতাহ ২৮)। এটাই যে তাঁর রসুল প্রেরণের উদ্দেশ্য সে বিষয়ে যেন কোনা ভিন্নমত, বিতর্ক বা সন্দেহের লেশও না থাকে সে জন্য তিনি এ কথটিও যুক্ত করে দিয়েছেন যে, এর সাক্ষী হিসাবে আল্লাহ স্বয়ং যথেষ্ট, কাফি।
পৃথিবীতে এমনিতেই বহু সংখ্যক উপাসক সম্প্রদায় ছিল এবং আছে। রসুলাল্লাহ (সা.) এর মধ্যে আরো একটি উপাসক সম্প্রদায় যোগ করার জন্য আসেন নি। তিনি অর্থহীন কাজ করার মানুষ ছিলেন না। তিনি যে উম্মাহ গড়ে তুলেছিলেন সে উম্মাহর প্রতিটি সদস্যের মনে মগজে তিনি গেড়ে দিয়েছিলেন যে কেন তাদেরকে সৃষ্টি করা হয়েছে, পৃথিবীতে তাদের কাজ কী? তিনি নিজে তাদেরকে সঙ্গে নিয়ে মাত্র দশ বছরে অন্তত একশত সাতটি সামরিক অভিযান পরিচালনা করেছেন। নিজে অংশ নিয়েছেন সাতাশটিতে।
এভাবে তিনি হেজাজের সাড়ে বারো লক্ষ বর্গ কিলোমিটার ভূখণ্ডে আল্লাহর সত্যদীন প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে একটি অকল্পনীয় ন্যায় ও সুবিচারপূর্ণ, জ্ঞানে বিজ্ঞানে, সম্পদে সমৃদ্ধ একটি সভ্যতার ভিত্তি নির্মাণ করে যান। তিনি ও তাঁর পরবর্তীতে খোলাফায়ে রাশেদার যুগে এই সভ্যতার রাজনৈতিক কাঠামো, অর্থনৈতিক ব্যবস্থা, সামরিক শৃঙ্খলা, সামাজিক ব্যবস্থা ইত্যাদি পূর্ণাঙ্গতা লাভ করে।
খুবই অল্প সময়ের মধ্যে এই উম্মাহ সামরিক শক্তিবলে তদানীন্তন অর্ধ দুনিয়ার কর্তৃত্ব অর্জন করে এবং সেখান থেকে সকল অন্যায় অবিচার অনাচার দূর করে মানুষের ধর্মীয় স্বাধীনতাসহ সকল মানবাধিকার নিশ্চিত করে। সেটা ছিল মুসলিম উম্মাহর সোনালি অধ্যায়।
আর আজ তার সম্পূর্ণ বিপরীত। আজকে মুসলিম মানে হচ্ছে নিছক একটি উপাসক সম্প্রদায়। তাদের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামাজিকসহ যাবতীয় অঙ্গনে কর্তৃত্ব করছে পাশ্চাত্যের তৈরি বিধি-নিষেধ ও মূল্যবোধ। সংখ্যার আধিক্য ছাড়া তাদের আর গৌরব করার কিছুই নেই। কিন্তু মর্যাদা লাভের জন্য কোয়ন্টিটি বা সংখ্যার কোনো গুরুত্ব বাস্তবে থাকে না। গুরুত্ব থাকে কোয়ালিটি বা গুণাবলীর।
সেই জাতি ছিল ঝড়ের মতো গতিশীল। অর্ধেক দুনিয়ার শাসন কার্য পরিচালনার জন্য তাদেরকে দিনরাত থাকতে হয়েছে কর্মব্যস্ত। প্রতি মুহূর্তে সামনে আসছে নতুন নতুন সংকট। সেগুলোর মোকাবেলা করে জাতি প্রতি মুহূর্তে পার হয়ে যাচ্ছে উৎকর্ষের একেকটি সোপান। এভাবে জাতি উঠে গেছে উন্নতির চরম শিখরে। মানবজাতি প্রত্যক্ষ করল ঐশী কেতাবের জ্যোতি কতটা প্রখর হতে পারে। মানবজাতি ন্যায় ও সত্যের বাস্তব রূপ দেখল মোমেনদের মাধ্যমে।
অন্যান্য জাতি অবাক বিস্ময়ে তাকিয়ে দেখেছে মুসলিম শাসকদের হিমাদ্রিসম ব্যক্তিত্ব, তাদের সভ্যতার বিরাটত্ব ও চিন্তার উদারতা। তারা তাকিয়ে থেকেছে মুসলিম শাসনের রাজনৈতিক কেন্দ্র বাগদাদ, আলেকজান্ড্রিয়া, ইস্তাম্বুল, গ্রানাডা, কর্ডোবা, আলেপ্পো, কায়রোয়ান, তিলমেসান, নাজাফ, দামেস্ক, বোখারা, সমরখন্দ, দিল্লি, গৌড়ের নগরসমূহের পানে। ঠিক যেভাবে আজ আমরা মন্ত্রমুগ্ধের মতো তাকিয়ে থাকি নিউ ইয়র্ক, লন্ডন, মস্কো, আমস্টার্ডাম, প্যারিস, ভিয়েনা, অসলো ইত্যাদি পাশ্চাত্যের উন্নত শহরের দিকে।
মন্তব্য করুন এখানে